হানিমুনে দার্জিলিং

প্রথম ভ্রমনের পর দ্বিতীয় ভ্রমন অনেক দিন পর। কিন্তু দ্বিতীয় ভ্রমন ছিল অনেক গুরুত্তপূর্ণ। কারন এইটা ছিল হানিমুন ট্যুর।

আমরা রাতের বেলা বাসে উঠে খুব ভোরে বর্ডার এলাকায় চলে আসলাম। সকালে উঠে বুড়ির হোটেলে নাস্তা করে দালালকে পাসপোর্ট দিয়ে দিলাম। দালাল সব কাজ সেরে বর্ডার খোলার সাথে সাথে আমাদের বর্ডার পার করে দিলো। বর্ডার পার হয়ে আমরা ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, পুলিশ কাউন্টার হয়ে মানি একচেঞ্জার অফিসে গেলাম। এরপর ডলার রুপিতে একচেঞ্জ করে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আগের বারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রিক্সা না নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত গেলাম। তারপর বাসের জন্য অপেক্ষা। গন্তব্য শিলিগুড়ি।

বাস আসার পর শুনলাম ডাইরেক্ট বাস নেই। ডাইরেন্ট বাস পেতে হলে রিক্সায় করে আরেক জায়গায় যেতে হবে। উপায় না দেখে রিক্সায় চড়ে বসলাম। রিক্সা কুচবিহারের ভিতরের রাস্তা দিয়ে চলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে আমরা একটা বড় রাস্তায় আসলাম। রিকশাওয়ালা বললেন এইটাই বাস স্ট্যান্ড। জায়গাটা একটা রাস্তার মধ্যে খোলা জায়গা। বাস স্ট্যান্ডের কোনও নিশানা নাই। তাও দাড়ালাম। রিকশাওয়ালাকে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ বাদে বাস আসলো। আমরা রিক্সা ছেড়ে বাসে উঠলাম। বাসে তিল ধারনের জায়গা নেই। আমরা ব্যাগ ছাদে দিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে যেতে লাগলাম। আমার সদ্য বিবাহিত বউ আমার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার হানিমুন গন্তব্যে যাচ্ছে।

আফরিন কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সিট পেয়ে গেল। আমি পেলাম শিলিগুড়ি আসার কিছু আগে। শিলিগুড়ি নেমে দালাল এড়িয়ে, আমরা দার্জিলিং যাবার জিপে চেপে বসলাম। জিপ শিলিগুড়ি ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। আর আমি দেখলাম, আফরিন মুগ্ধ চোখে বাইরে তাকিয়ে পাহাড় দেখতে লাগলো।

দেখতে দেখতে আমরা দার্জিলিং পৌছে গেলাম। সময়টা ছিল ২০০৬ সালের ডিসেম্বর। বিকাল। বেশ ঠাণ্ডা আবহাওয়া। কিন্তু কোনও মেঘ নেই। কিছুটা হতাশ লাগলো, কারন আমি মেঘ দেখবো আর দেখাবো ভেবেছিলাম।

হোটেল নিলাম। হোটেলের জানালা দিয়ে দূরে পাহাড় দেখা যায়। রাতের বেলা সেই পাহাড়ে একটা দুইটা আলো জ্বলে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা।

আমরা দুপুরে খাইনি। তাই হোটেলেই খাবার অর্ডার দিলাম। খাবার খেয়ে বাইরে বের হলাম। তেমন কোন তাড়াহুড়া নেই। ৫ দিন থাকব। রিলাক্স করে ঘুরব।

হাঁটতে হাঁটতে মল রোডের দিকে চলে গেলাম। ঠান্ডার মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেলাম। আরও বেশি ভালো লাগলো দেখে যে আফরিন দার্জিলিং পছন্দ করেছে।

পরদিন আমরা টাইগার হিল দেখতে যাবো। হোটেলে বুকিং দিয়ে দিলাম। ভোর সাড়ে তিন টায় জিপ এসে নিয়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম।

পরের দিন ভোর সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে জিপে করে চললাম টাইগার হিল দেখতে। প্রচন্ড ঠাণ্ডা। গায়ে কয়েক লেয়ারের পোশাক। টাইগার হিলে পৌছে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠতে লাগলাম। উপরে অব্জারবেশন টাওয়ার আছে। তার বাইরে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা আছে। সেই খোলা জায়গায় কয়েকশ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সূর্যদোয় দেখবে এবং সূর্য উঠার সময় উল্টা পাশে কাঞ্চনজঙ্গার বরফে সূর্যের লাল আভা দেখা যায়। যেটা অনেক বেশি সুন্দর। তবে আকাশে মেঘ থাকলে দুটোর কোনটাই দেখা যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। আমরা দুটোই দেখতে পেরেছিলাম।

প্রচন্ড ঠান্ডায় সূর্য উঠার অপেক্ষায় টাইগার হিলে
প্রচন্ড ঠান্ডায় সূর্য উঠার অপেক্ষায় টাইগার হিলে
সূর্য উঠার পর উল্টা পাশে কাঞ্চনজঙ্গার চুড়া
সূর্য উঠার পর উল্টা পাশে কাঞ্চনজঙ্গার চুড়া (পিছনে)
সূর্য উঠার পর উল্টা পাশে কাঞ্চনজঙ্গার চুড়া
টাইগার হিল

    

টাইগার হিলে সবাই খালি পেটে যায় আর শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে সারাক্ষণ কফি খেতে থাকে। আশে পাশে কফির ফেরিওয়ালা আর ফটোগ্রাফার প্রচুর।

টাইগার হিল থেকে নামার সময় আমাদের ঘুম রেল ষ্টেশন নেয়া হল। ঘুম ষ্টেশন ৭৪০০ ফিট উপরে এবং ঘুম মনাস্ট্রির পাশে। এর পাশেই আছে বাতাশিয়া লুপ যা শহীদ গোর্খা সৈনিকদের সন্মানে তৈরি করা। বাতাশিয়া লুপের চারপাশে অসংখ্য ফেরিওয়ালা, যারা শাল, মোজা, চা পাতা বিক্রি করে। সাধারণত নিম্ন মানের চা পাতা এইখানে পাওয়া যায়, যারা জানে না, তারা এর শিকার হয়।

ঘুম মোনাস্ট্রির সামনে
ঘুম মোনাস্ট্রির সামনে

সব শেষে আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম। নাস্তা করলাম দার্জিলিং এর বিখ্যাত চাউমিন দিয়ে।  এর পর আমরা গেলাম রক গার্ডেন। রক গার্ডেন হল পাহাড় আর ঝর্নার বাগান। পুরো এলাকাটা সুন্দর। ঘুরে ঘুরে আর ছবি তুলে আমরা সময়টা পার করলাম। পাহাড়ি রাস্তায় আসা যাওয়ার অভিজ্ঞতাটাও ছিল দারুন।

রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন
রক গার্ডেন

 

পরের দিন গেলাম দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, হিমালয় মাউন্টেনেরিং ইনস্টিটিউট ঘুরতে। চিড়িয়াখানাটা ছোট কিন্তু বেশ কয়েকটা পশু আছে দেখার মত। পশুগুলো ঠান্ডায় আরাম করে শুয়ে বসে আছে। দর্শনার্থীরা উচু নিচু রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে দেখছে।

হিমালয় মাউন্টেনেরিং ইনস্টিটিউট এ একটা মিউজিয়াম আছে। সেখানে তেঞ্জিং নরগে যিনি দার্জিলিং এ প্রথম এসেছিলেন, তার স্মৃতি বিজড়িত কিছু জিনিস আছে, পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য ছোট খাট একটা ব্যবস্থা আছে।

সেখান থেকে ফিরে এসে আমরা গেলাম জাপানিজ পিস মন্দির দেখতে। পাহাড়ের উপর বৌদ্ধ মন্দির আর তার পাশে পার্থনা করার জায়গা। খুবই সুন্দর আর সময় কাটানোর জন্য দারুন এক জায়গা।

সেইদন সন্ধ্যায় ঠিক করলাম ছবি দেখব। পাশেই আইনক্স সিনেমা হল। সেখানে ধুম ২ সিনেমা চলছিল। টিকেট কেটে দেখতে গেলাম, কিন্তু ২০-২৫ মিনিট পার হবার পরেই বের হয়ে গেলাম। ছবিটা বিরক্তকর মনে হচ্ছিল।

লোকাল এক রেস্টুরেন্ট এ
মল চত্তর থেকে কাঞ্চন জঙ্গা

পরদিন আমাদের ফেরার পালা। আমরা ঠিক করলাম যাবার সময় মিরিক হয়ে যাবো। মিরিক দার্জিলিং থেকে বেশ খানিকটা নিচে নামার পর কে বিশাল লেকের পাড়ে কিছুটা খোলা জায়গা। পিকনিকের জন্য আদর্শ স্থান। মিরিক যাবার পথে সীমানা নামে একটা জায়গা আছে যেটা ভারত আর নেপালের বর্ডার। সেখানে একটা ছোট বাজার আছে। ইচ্ছে করে নেপালে ঢুকে টুকটাক কেনাকাটা করা যায়।

মিরিকে এসে লেকে বোট চালানো আর লেকের পাশে বনে ঘুরা, এই করে সময় কাটাতে হবে। লেকে ঘুরতে আবশ্য ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।  ঘুরা শেষে, আমরা শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রউনা দিলাম। শিলিগুড়ি এসে হোটেলে উঠলাম। একরাত থাকবো আর কিছু কেনাকাটা করব। পরদিন সকালে গাড়ী ঠিক করে বর্ডারে পৌছে বাস ধরে ঢাকাতে চলে এলাম।

Please follow and like us: