প্রথম দার্জিলিং গেলাম ২০০২/২০০৩ এ। ওইটাই আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা। এক অদ্ভুত ভালো লাগা।
তখন ইন্ডিয়ান এম্বেসিতে সকালে গিয়ে লাইন ধরতে হতো আর ফর্ম ফিলাপ করে ঠিক মত জমা দিলে বিকেলে ভিসা দিয়ে দিত। তখন আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতাম। সেখানকার এক সিনিয়র আর ওনার কয়েকজন পরিচিত, এই ছিলো আমাদের গ্রুপ।
আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা প্রথমে দার্জিলিং যাবো এবং ওখানে দুই দিন থেকে পরে আমরা নেপাল যাব। তাই আমরা দুই দেশেরই ভিসা নিলাম। কিন্তু আমাদের প্ল্যানে কিছু ভুল ছিলো। যেহেতু প্রথম বিদেশ ভ্রমন, অনেক কিছুই আমরা জানতাম না। এক দেশের উপর দিয়ে আরেক দেশে যেতে যে “ডবল এন্ট্রি” ভিসা নিতে হয়, তা আমরা কারোই জানা ছিলো না।
যাই হোক। আমরা দিন ঠিক করে বাসের টিকেট কাটলাম। ওই সময়টা ছিল কুরবানির ঈদের সময়। বাসার কেউ রাজি ছিল না। কেউ বিশ্বাস করেনি যে আমি একা ঘুরতে যাবো। সবাই ভেবেছিল যে আমি যাবো না। কিন্তু আমি ঠিকই বেরিয়ে পরলাম।
গাবতলি থেকে বাসে উঠতে হল। আমরা বাসে উঠলাম। বাস চলে গেল বর্ডার এলাকায়। বাংলাদেশ পাশের নাম বুড়িমারী। ইন্ডিয়া পাশের নাম চেংড়াবান্ধা। আমার এখনও মনে আছে, আমরা খুব ভোরে বর্ডারে পৌছালাম।
সূর্য উঠার আগেই আমরা বর্ডারে পৌছে গেলাম। তখন বর্ডারে মাত্র একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। নাম ছিল বুড়ির হোটেল। সেই হোটেল চালায় বুড়ি আর তার জামাই। তার জামাই আবার বর্ডারের দালালি করে। মানে সে পাসপোর্ট, ট্যাক্স, ইমিগ্রেসন … সব কাজ করে দেয়।
বুড়ির দোকানে বেশ ভিড়। সবাই বর্ডার পার হবে। সবাই নাস্তা খাবে। দোকানের একটাই মেনু আর তা হলো ভাত এবং মুরগির মাংস। একাধারে মুরগি জবাই হচ্ছে, রান্না হচ্ছে আর পরিবেশন হচ্ছে।
আমরা বর্ডার পার হলাম। বাংলাদেশ পাশে তেমন কোনও ঝামেলা হলো না, কিন্তু ইন্ডিয়া পাশে বেশ ঝামেলা হল। প্রথমত, আমাদের ইন্ডিয়ান ভিসাতে এই বর্ডারের নাম নেই। যেই বর্ডারের নাম আছে, তা কেউ চিনে না। অনেক অনুরধের পর (এবং কিছু টাকা ঘুষ দেয়ার পর) তারা ভিসার উপরে এই বর্ডারের নাম হাতে লিখে আমাদের যেতে দিলেন। আমরা ইন্ডিয়াতে ঢুকলাম আর আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা শুরু হল।
বর্ডার পার হবার পরে, আমরা ডলার ভাঙ্গালাম। এরপর কিছু দূরে গিয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশে বাসে উঠলাম। ঘন্টা তিন বা চার পর আমরা শিলিগুড়ি পৌছালাম। শিলিগুড়ি নেমে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। দার্জিলিং এর জন্য গাড়ি খুজতে গিয়ে পরলাম বিপদে। আশে পাশে শত শত দালাল। সবাই হোটেল ঠিক করে দিবে। এক কথায় জোর করে আমাদের হোটেল ঠিক করে দিল। বলল, হোটেলে গরম পানি সহ খাবার দাবার সবই পাওয়া যাবে। যাই হোক, হোটেল ঠিক করে, একদিনের অগ্রিম দিয়ে, আমরা গাড়িতে উঠলাম।
যখন আমাদের গাড়ি শিলিগুড়ির ছেড়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগলো, কি যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা শুরু হল। পাহাড়ি রাস্তা, ক্রমশ উপরে উঠছি আর একটু একটু করে ঠান্ডা লাগা শুরু হল। রাস্তার একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশে লম্বা লম্বা পাইন গাছ। মাঝে একবার একটা বিরতি দিল কয়েক মিনিটের জন্য। আবার যাত্রা শুরু করলাম। সন্ধ্যা নাগাত আমরা দার্জিলিং পৌছালাম।
দার্জিলিং পৌছে প্রথমে আমারা আমাদের বুকিং করা হোটেল খুঁজে বের করলাম। পুরাই হতাশ হতে হল। খুবই বাজে হোটেল। রুম অনেক নোংরা, গরম পানির ব্যবস্থা নেই। দার্জিলিং এ সব সময় গরম পানি লাগে, কারন আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা।
আমরা বুঝলাম এই হোটেল থাকা যাবে না। টাকা নস্ট হলেও কিছু করার নাই। আমরা হোটেল খুজতে লাগলাম। কিছুদুর যেতেই হোটেল পেয়ে গেলাম। রুম সবার পছন্দ হল। আমরা হোটেলে চেক ইন করে খাবারের উদ্দেশে বের হয়ে গেলাম।
কিছুদুর যেতেই একটা বাঙ্গালী রেস্টুরেন্ট পেয়ে গেলাম। ভরপেট খেলাম, যেন অনেক দিন কিছু খাইনি। খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফেরত আসলাম। হোটেলে এসে আমরা পরের দিনের জন্য ট্যুর প্লান করলাম আর গাড়ি বুকিং দিলাম।
আমাদের পরের দিনের প্রথম প্লান হল টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখা। এরপর আসার সময় ঘুম রেল ষ্টেশন, বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি।
টাইগার হিলে যেতে হলে ভোর রাতে যেতে হয়। যখন সূর্য উঠে, উলটা পাশে হিমালয়ের বরফে তার দারুন রিফ্লেক্সন হয়। খুব সুন্দর একটা দৃশ্য। আনুমানিক রাত সাড়ে চারটায় রওনা দিতে হয়। আমরা ভোর সাড়ে চারটায় রওনা দিলাম। কিন্তু আমাদের ভাগ্য খারাপ। ওইদিন আকাশ বেশ মেঘলা ছিল। সূর্য ভালো ভাবে দেখা হল না। আমরা সেই পাহাড় থেকে নেমে এলাম।
আসার সময় আমরা আরও তিনটি জায়গায় গেলাম। যতদূর মনে পরে, আমরা ঘুম ট্রেন স্টেশন, বোদ্ধ মনাস্ত্রি, আর বাতাসিয়া লুপ এ গেলাম। এরপর আমরা হোটেল এ চলে আসলাম।
আমাদের প্লান ছিল আমরা দার্জিলিং এ দুই দিন থাকব আর নেপালে পাঁচ দিন থাকব। এই আমাদের ৭ দিনের প্লান।
যেহেতু দুই দিনের প্লান, পুরা দৌড়ের উপর। সকালের ট্যুর শেষে আমরা নাস্তা করে আবার ছুটলাম পরের গন্তব্যে।
পরের গন্তব্য ছিল ৭ পয়েন্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হিমালয় মউন্টেন ইনিস্টিটিউট, তার সাথের চিড়িয়াখানা, রোপ ওয়ে এবং সব শেষে রক গার্ডেন। রক গার্ডেন হল পাহাড়ের মাঝে একটা পাথরের বাগান। মাঝে মাঝে হাঁটার সুন্দর ব্যবস্থা। খুব ভালো লাগলো জায়গাটা। আমরা বেশ কিছুক্ষণ থেকে আবার শুরু করলাম। প্রতিটা জায়জাই অসম্ভব সুন্দর।




ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেল। আবার ও সেই বাঙালি হোটেলে ভর পেট খাওয়া আর খাবার শেষে ঘুম।
পরদিন আমাদের সকালে হোটেলে চেক আউট করে নেপাল বর্ডারের (রানিগঞ্জ) উদ্দেশে যাত্রা সুরু করতে হবে। পথে জাবার সময় আমরা দুই জায়গায় থামব। একটা হল নেপাল বর্ডার (এটা পাহাড়ের মাঝে একটা বর্ডার, যা দিয়ে মানুষ পার হয় না, শুধু পণ্য আনা নেয়া হয়) আর একটা হল মিরিক। নেপাল বর্ডার খুব আহামরি কোনও জায়গা না। কিন্তু মিরিক অনেক সুন্দর একটা জায়গা। পাহাড়ের অনেকটা নিচে একটা বিশাল লেক আর তার পাশে বন। পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা।
মিরিক ঘুরে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।
বর্ডারে (রানিগঞ্জ) যখন পৌছালাম তখন দুপুর। আমরা ইন্ডিয়া পাশে ইম্মিগ্রেশনে দাঁড়ালাম। ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধেই আমাদের জানালেন, আমরা যেতে পারবো না। দুইটা কারন। আমাদের ডবল এন্ট্রি ভিসা নাই। আর আমাদের ভিসাতে ওই বর্ডারে এক্সিট পারমিশন নেই।
আমরা প্রথমে আনুরোধ করলাম, পরে ইনিয়ে বিনিয়ে টাকা অফার করলাম। কিন্ত তারা তাদের সিন্ধান্তে বেশ অটল। আমরা ঘন্টাখানেক থেকে ফেরত চলে আসলাম শিলিগুরি শহরে। যেহেতু নেপাল যাবো বলে, দার্জিলিংএ তাড়াহুড়া করলাম, আর নেপালই যেতে পারলাম না, পুরো টিম বেশ হতাশ।
যাই হোক, সেই রাত কোনও মতে একটা হোটেলে থেকে পরদিন আমরা বাংলাদেশ এ ফেরত আসলাম। আমার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন শেষ হল।