ক্যামেরুন হাইল্যান্ড নিয়ে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কারন উচ্চতার মাপে এটা গেন্টিং হাইল্যান্ড থেকে নিচে। এতে দেখার মত শুধু চা বাগান আছে (বাংলাদেশের সিলেটের মালনিছড়ি, শ্রী মঙ্গলে আমি চা বাগান দেখেছি)। তাই শুধু চা বাগান দেখার জন্য, কুয়ালালামপুর থেকে তিন/চার ঘন্টা ভ্রমন করে যাওয়া, আমাকে খুব একটা আগ্রহী করেনি।
আমি প্রথম ক্যামেরুন হাইল্যান্ড যাই ২০১৪ সালে। আমরা তখন বাংককে থাকি। রোজার ঈদের সময় এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে কুয়ালালামপুর এসেছি। প্লান ছিল শুধু কুয়ালালামপুর আর তার আসে পাশে ঘুরব। রাতে ক্যামেরুন হাইল্যান্ড থাকব না, এটা ঠিক করে, যাওয়া আসার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম। ওইটা ছিল ঈদের আগের দিন। সকাল সকাল আমরা যাত্রা শুরু করলাম যেন, বেশি ঘুরতে পারি।
সেই দিন আমরা বুজতে পেরেছি “বালিক কাম্পুং” কি জিনিস। বাংলাদেশে যেমন ঈদের সময় সবাই গ্রামে যেতে চায় এবং এর জন্য হাইওয়েতে ভয়াবহ জ্যাম থাকে, এইখানেও তা। সবার একসাথে গ্রামে বেড়াতে যাওয়াকে বলে “বালিক কাম্পুং”। ভয়াবহ জ্যামে বসে থাকলাম। গাড়ি নড়েই না।তিন ঘন্টার রাস্তা যেতে আমাদের প্রায় সারাদিন লেগে গেল। সকাল ৮ টায় রওনা দিয়ে আমরা ক্যামেরুন হাইল্যান্ড পৌছালাম বিকেলে। এরপর খালি একটা চা বাগানে গিয়ে কিছু ছবি তুলে আবার কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
এর পর আবারও যাওয়ার প্লান করলাম, কিন্তু যেতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল ক্যামেরুন হাইল্যান্ড নিয়ে আমার কখনও কোনও ভালো অভিজ্ঞতা হবে না।
যাই হোক। আবার প্লান করলাম। দীপাবলির ছুটি আর উইকেন্ড মিলিয়ে তিন দিনের বন্ধ। ঠিক করলাম দুই রাত থাকব। হোটেল বুকিং দিলাম এবং নির্দিষ্ট দিনে আমরা খুব সকালে যাত্রা শুরু করলাম।
অফিস কলিকদের থেকে ক্যামেরুন হাইল্যান্ড যাওয়ার ভালো রাস্তা শুনে, জি পি এসে তা সেট করে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। মাঝখানে একটা বিরতি নিলাম। বাসা থেকে বানানো বার্গার খেলাম এবং আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর বুঝলাম, জি পি এস আমাদের ক্যামেরুন হাইল্যান্ড এর পুরানো রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা পাহাড়ি চিকন এবং খুবই আঁকা বাঁকা রাস্তা।
যাই হোক, তিন, চার ঘুন্টায় আমরা ক্যামেরুন হাইল্যান্ড পৌছে গেলাম। শুক্র বার ছিল। হোটেলে চেক ইন করে রুম দেখে তো মাথা ঘুরে গেল। লম্বা ড্রাইভিঙের ক্লান্তি আমারে বিছানায় টানছিল। কিন্তু জুম্মার নামাজের সময় হয়ে যাওয়াতে, আমি মসজিদের খোঁজে বের হয়ে গেলাম।
কাছেই একটা হিলের উপরে খুব সুন্দর লোকেশনে একটা মসজিদ পেয়ে গেলাম। নামাজ শেষ করে, হোটেলে এসে আবার বের হতে হল, দুপুরের খাবার জন্য। কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বের হলাম বহ ট্রি প্লান্টেশনে তাদের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে জাবার জন্য। জি পি এসে ঠিকানা দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমরা এক চা বাগানের ভিতর দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছিল। তার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় চা বাগানের ভিতর দিয়ে তীব্র এবং তীক্ষ্ণ বাঁকের রাস্তা দিয়ে একসময় আমরা পৌছে গেলাম জি পি এসের উল্লেখিত নির্দিষ্ট জায়গায়। ঠিক তখন আমরা খেয়াল করলাম আমরা ভুল জায়গায় চলে এসেছি। এটা বহ কোম্পানির আরেকটা রেস্টুরেন্ট ।
বিরক্ত লাগলো। একেতো আঁকা বাঁকা রাস্তা, তার পরে বৃষ্টি, এবং ভুল রাস্তা।
আসার পথে আমরা নাইট বাজারে যেতে চাইলাম। কিন্তু এত বৃষ্টি যে গাড়ি থেকে বের হতেই পারছিলাম না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর, আমরা নাইট বাজারে যেতে পারলাম। খুব আহামরি কোন বাজার না। মালয়েশিয়ার আর আট দশটা বাজারের মত এটাও খাবারের দোকানে ভরা। চোখে পড়ার মত স্ট্রবেরির অনেক দোকান দেখলাম এবং স্ট্রবেরির অনেক আইটেমও দেখলাম যেমন, ফ্রেশ স্ট্রবেরির, চকলেট স্ট্রবেরির, স্ট্রবেরির জ্যাম, স্ট্রবেরির জেলি, স্ট্রবেরির জুস, স্ট্রবেরির পিকল …
আমরা ঠিক করলাম, আজকে এই বাজার থেকে খাবার কিনে নিয়ে হোটেলে গিয়ে খাব। খাবার কিনা হল আর খাবার নিয়ে হোটেলে ফিরে আসা হল।
হোটেলে এসে খাবার বের করে খেয়ে নিলাম। খাবার বেশির ভাগই ভাজি এবং বেশ মজা। খাবার খেয়ে, বারান্দায় গিয়ে দেখলাম বৃষ্টির কোনও কমতি নেই। তাই রাতের আর কোনও প্লান হল না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়লাম বহ টি গার্ডেনের সেই রেস্টুরেন্ট দেখতে। এইবার জি পি এস ভালভাবে দেখে সেট করে নিলাম। মেইন রাস্তা থেকে একটু পরেই পাহাড়ি রাস্তায় ঢুঁকে গেল। রাস্তায় বেশ কিছু তীক্ষ্ণ বাঁক ছিল এবং বেশ কয়েক যায়গায় শুধু একটি গাড়ি চলতে পারে। তখন অন্য পাশের সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়।
অনেক ঝক্কি ঝামেলা সামলে আমরা পৌছালাম বহ ট্রি প্লান্টেশনের সেই রেস্টুরেন্টে। নিচে গাড়ি পারকিং করে, আমরা হেঁটে হেঁটে উপরে উঠতে লাগলাম। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক ভিড়। কোনও সিট খালি নেই। অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সবার জন্য। আবার আরেকটা বড় লাইন খাবার অর্ডার করার জন্য। রেস্টুরেন্টের একটা অংশ খোলা, কিন্তু বাকি অংশটা চারদিকে কাঁচের জানালা দেয়া। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ গেলে শুধু চা বাগান দেখা যায়।
আমরা একটা টেবিলের একাংশ দখল করে গেলাম খাবারের লাইনে। খাবার হল মুলত কেক, ব্রেড, বিভিন্ন স্নাক আর বিভিন্ন ফ্লেবারের চা। আমরা কেক আর চা অর্ডার করে, তা নিয়ে টেবিলে ফেতর আসলাম। কিছুটা সময় থেকে আমরা আশ পাশ দেখতে গেলাম। পাশেই একটা সুভেনির শপ আছে যেখানে বিভিন্ন ফ্লেবারের টি ব্যাগ বিক্রি করে। আমরা বেশ কিছু ফ্লেবারের টি ব্যাগ কিনে চা বাগানের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা ধরে নিচে নামতে লাগলাম।
নামার পথে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে আবার ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করলাম। ফিরতি পথে আমরা মৌমাছির খামার, প্রজাপতির খামার আর স্ট্রবেরীর খামার দেখতে গেলাম। পথের মধ্যে এক যায়গায় থেমে দুপুরের খাবার খেলাম। ঠিক সেই সময় প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল, আমরা খাওয়া শেষ করেও বের হতে পারলাম না। অপেক্ষা করতে হল। এরপর বৃষ্টি থামলে, আমরা হোটেলের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। আবারও বৃষ্টি পড়তে লাগল। একটানা বিরক্তিকর বৃষ্টি।
আসার পথে একটা কফি শপে থামলাম। এটা কফি শপ এবং বার। আমরা দুটো কফি আর আমার ছেলের জন্য লিকার চা অর্ডার দিলাম। আবহাওয়া খুবই চমৎকার। আমরা খুব মজা করে কফি খেলাম। কফি শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। একটানা একঘেয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি যদি না থাকত, তবে বাইরে হাঁটার জন্য চমৎকার একটা সময় থাকত।
হোটেলেই আটকে থাকলাম। রাতে খেতে বের হলাম। এত বৃষ্টি যে, গাড়ি পার্ক করে হেঁটে আসতে আসতে পুরো পুরি ভিজে গেলাম। খাবার জন্য খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে পড়লাম। নান রুটি, মাংস, ডাল আর সবজি অর্ডার করলাম। খাবার খেয়ে আমরা ঠিক করলাম আইস্ক্রিম খাব। আইস্ক্রিম কেনা হল, খাওয়া হল। সব শেষ করে, আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম।
পরদিন সকালে আমরা হোটেলে চেক আউট করে, ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করলাম। মাঝখানে থেকে থেকে বেশ কয়েকটা যায়গায় দাড়িয়ে ফ্রেশ সবজি কিনলাম, ফল কিনলাম, দুপুরের খাবার খেলাম। এরপর টানা গাড়ি চালিয়ে আমরা তিন ঘণ্টায় বাসায় পৌছে গেলাম।